নববর্ষের ভোর। হাসপাতালের বারান্দায় অধীর অপেক্ষায় নাজির মাহমুদ মুবিন। তাঁর স্ত্রী তমা আক্তার তখন অস্ত্রোপচার কক্ষে। সন্তানের মুখ দেখার যেন আর তর সইছে না মুবিনের। এর মধ্যে সকাল ৬টায় এক নার্স কাপড়ে মোড়ানো নবজাতককে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। তিনি অপেক্ষারত মুবিনকে জানালেন, ‘আপনি ছেলেসন্তানের বাবা হয়েছেন।’ কাঁপা কাঁপা হাতে সন্তানকে কোলে তুলে নিলেন মুবিন। তাঁর চোখে আনন্দের অশ্রু টলমল করছে।
বাবা হওয়ার অনুভূতি কেমন– জানতে চাইলে নাজির মাহমুদ মুবিন বলেন, ‘প্রথম সন্তানের মুখ দেখার মতো সুন্দর মুহূর্ত পৃথিবীতে আর নেই। এই মুহূর্ত থেকে আমি একজন বাবা। আমার জীবন পূর্ণ।’
নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার গোলাহাট এলাকার আলী হোসেন ও মনোয়ারা বেগম দম্পতির ছেলে মুবিন। তিনি ইউনিলিভার বাংলাদেশের মার্কেটিং বিভাগে চাকরি করেন। তমা আক্তার গৃহিণী। এই দম্পতির এটিই প্রথম সন্তান।
মুবিন বলেন, ‘ডেলিভারি ডেট অনুযায়ী ভেবেছিলাম, সন্তানের সঙ্গে যদি আমরা পহেলা বৈশাখ উদযাপন করতে পারতাম, তাহলে খুব ভালো হতো। সেটিই হলো। এবার পহেলা বৈশাখ আমাদের জন্য খুবই স্পেশাল।’
ছেলের নাম এখনও নির্বাচন করতে পারেননি মুবিন। তিনি বলেন, ‘বাড়ির মুরুব্বিরা আমার সন্তানের নাম যেটি রাখবেন, সেটিই হবে। তাকে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাই।’
কথাগুলো বলে সন্তানের কপালে চুমু দিয়ে শাশুড়ি কৌহিনুর বেগমের কোলে তুলে দিলেন মুবিন। মনে হলো তাঁর ওপর থেকে শঙ্কার কালো মেঘ কেটে গেছে। এবার নিজের স্বপ্নপূরণের কথা জানালেন তিনি।
মুবিন জানান, ভালোবেসে ২০২৩ সালের ২৮ এপ্রিল তমার সঙ্গে ঘর বাঁধেন। তমার বাড়ি একই উপজেলার কামারপুকুর ইউনিয়নের মতির মোড় এলাকায়। মুবিন তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। তমাদের এলাকায় একদিন বিকেলে ঘুরতে গিয়ে তাদের প্রথম দেখা। তমা তখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়েন। প্রথম দেখাতেই ঠিক করলেন, তাঁকেই জীবনসঙ্গী করবেন। সেই দিন থেকে প্রতিদিন সময় করে দেখা হোক বা না হোক একবার তমার বাড়ির এলাকা ঘুরে আসতেন মুবিন। যে দিন দেখা হতো, সে দিন যেন তাঁর ঈদ! এভাবে তিন বছর পর একজনের সহযোগিতায় তাঁকে ভালোবাসতে তমাকে রাজি করালেন। তমাও একপর্যায়ে ভালোবেসে ফেলেন মুবিনকে। পরে উভয় পরিবারের সম্মতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বিয়ে হয়।
মুবিন বলেন, ‘সবকিছু এতটা সহজ ছিল না। দুই পরিবারের কেউ না কেউ বিয়েতে অমত দিয়েছিল। পরে সবাই রাজি হয়। এর মধ্যে বিয়ের দুই মাস পর তমা অন্তঃসত্ত্বা হয়। সে সময় অকাল গর্ভপাত ঘটে। এ কারণে দ্বিতীয়বার সন্তান গর্ভে আসার পর তমার অনেক যত্ন নিই। সাধ ও সাধ্যের মধ্যে চিকিৎসকসহ যে যা বলেছেন, তাই করেছি।’
মা হতে পেরে খুব খুশি তমা আক্তার। তিনি বলেন, ‘মা হওয়ার অনুভূতি পৃথিবীর সেরা। সৃষ্টিকর্তার কাছে একটাই প্রার্থনা ছিল– একটি সন্তান। অবশেষে তা পেয়েছি। আমি ভীষণ খুশি। এতদিন শুনে এসেছি প্রথম মা হওয়ার পরম আনন্দের অনুভূতির কথা। এবার আমিই মা হলাম। ৯ মাস গর্ভধারণ ও সিজারের কষ্ট সব এখন ভুলে গেছি।’
প্রথমবার গর্ভপাতের ঘটনায় খুব কষ্ট পেয়েছিলেন তমা। তিনি বলেন, ‘যেদিন গর্ভে দ্বিতীয়বার আবার নতুন প্রাণের উপস্থিতি জানতে পারি, সেই দিন থেকে কোনো ঝুঁকি নিইনি। পর্যাপ্ত বিশ্রামে ছিলাম। শাশুড়ি কোনো কাজ করতে দেননি। মায়ের বাড়িতে আসার পর মা ও ছোট বোনও খুব যত্ন নিয়েছে। সৃষ্টিকর্তার দয়ায় পৃথিবীর সেরা উপহার পেয়েছি। সবার কাছে দোয়া চাই, সে যেন সুস্থ থাকে, আর মানুষের মতো মানুষ হতে পারে।’
নাতিকে পেয়ে আপ্লুত কৌহিনুর বেগম। তিনি বলেন, ‘তমা আমার দ্বিতীয় মেয়ে। তার গর্ভে সন্তান আসার খবর শুনে তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসি। এ সময় সব মেয়েই মায়ের কাছে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কারণ মাকে তারা সব কিছু খুলে বলতে পারে। সেই চিন্তা করে তাকে নিয়ে আসি। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। হঠাৎ ১১ এপ্রিল রাতে প্রচণ্ড ব্যথা ওঠে। দেরি না করে হাসপাতালে নেওয়ার চিন্তা করি। চিকিৎসক উপজেলা শহরের লাইফ হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভর্তির পরামর্শ দেন। গ্রাম থেকে সেই হাসপাতালে নেওয়া সহজ ছিল না। অত রাতে রিকশা বা ভ্যান পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেক দূর থেকে একটি অটোরিকশা আনা হয়। সেই রিকশায় চড়ে ভাঙাচোরা সড়ক পেরিয়ে তারপর হাসপাতালে পৌঁছাই। হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্সসহ সবাই আন্তরিক। আসার সঙ্গে সঙ্গে তারা আমার মেয়ের চিকিৎসা শুরু করে দেন। বিশেষ করে ডা. অমৃতা আগারওয়ালের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। কারণ পহেলা বৈশাখের আগের দিন রাত থেকে তিনি নরমাল ডেলিভারির জন্য চেষ্টা করেছেন। না হওয়ায় পরে বাধ্য হয়ে তিনি অস্ত্রোপচার করেন। এখন মা ও সন্তান দুই জনেই সুস্থ।’
ডা. অমৃতা আগারওয়াল বলেন, ‘তমা নিয়মিত চেকআপে ছিলেন। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলেছেন। এ কারণে তাদের তেমন কোনো জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়নি। মা-সন্তান দু’জনেই সুস্থ। বুধবার তাদের রিলিজ দেওয়া হতে পারে।’
লাইফ হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিচালক আব্দুর রশিদ শাহ বলেন, ‘আমরা শিশুটির মা-বাবাকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছি। আমাদের হাসপাতালটি নতুন। তাই বিষয়টি সেভাবে আমাদের চিন্তায় আসেনি। এলে হয়তো আরও ভালোভাবে শুভেচ্ছা জানানো যেত। সামনের বছর থেকে এমন দিন নবজাতকের জন্য স্মরণীয় করে রাখতে উদ্যোগ নেওয়া হবে।’